গ্রীস্ম বনাম বর্ষা -শরীয়তুল্লাহ সোহন
জৈষ্ঠ মাস, চারিদিকে গ্রীস্মের প্রচন্ড দাবদাহ তাপ। খোদার আসমান ছেদ করে , জমিন ভেদ করে ও প্রকৃতির বুক বিদীর্ন করে রুক্ষতা ও শুস্কতা যেন উপহাস করছে বর্ষাকে। রৌদ্রের তীব্রতা বর্ষাকে চোখ রাঙিয়ে যেন ধমকের সুরে বলছে, "দেখ আমি সর্বগ্রাসী! আমি চাই, আকাশ-পাতাল করে ভেদ করে খোদার আরশ কাঁপিয়ে সমগ্র প্রকৃতিকে গ্রাস করতে।" আমি চাই আমার তীব্র তাপে মাটির মধ্যে থেকে শেষ জলবিন্দু শোষন করে ফাটল ও গহ্বরের সৃষ্টি করতে । তারপর সেই ফাটল ধরা জরাজীর্ন ভূমিতে নৃত্য করবো তীব্র উল্লাসে। সেই নৃত্যের ছন্দে জলের তীব্র আঙ্খাক্ষায় প্রকৃতির অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়বে। জনপদগুলোর বাসিন্দারা জলের তীব্র চাহিদা নিয়ে প্রার্থনা করবে সর্ব শক্তিমানের কাছে। চাষীরা মাথায় হাত দিয়ে একরাশ হতাশা ও মনভরা যন্ত্রনা নিয়ে বসে থাকবে আমার বিদায়ের। চাতক পাখি গুলো, 'জল চাই, জল চাই' করে আকাশ -পাতাল ক্রন্দনরত বেদোনাসিক্ত চিৎকারে ফাটিয়ে তুলবে। বর্ষা, তবুও তোমার আগমন হবে না। তুমি সামর্থ্যহীন শিশুর মত দুর্বল চিত্তে চেয়ে থাকবে ওদের যন্ত্রনার দিকে। পারবে না আমাকে থামাতে। আর তোমার এই ব্যর্থতাই আমি নৃত্য করবো বিজয় উল্লাসে প্রানভরে ।
আমি বর্ষা! শুনে রাখো গ্রীস্ম, উই পোকার যখন পতনের সময় ঘনিয়ে আসে , ওরা যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়, তখন ঠিক তোমার মতই ওরা ডানা মেলে নৃত্য করে। কিন্তু ওরা যে ডানার জোরে এত তান্ডব দেখায়, সেই ডানায় তাদের মৃত্যর প্রধান কারন হয়ে দাঁড়ায়। আমি জানি আমার জন্ম মেঘ নামক এক পবিত্র সত্ত্বা থেকে। আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু হয়ে বৃষ্টি রুপে ঝড়ে পরি এই ধরিত্রী ভূমিতে । তবে আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু হয়ে ঝড়ে পড়লেও আমি কিন্তু দুর্বল নয়। গ্রীস্ম চেয়ে দেখ জৈষ্ঠ মাস শেষের দিকে। আমার জন্মলগ্ন আষাঢ় মাস প্রায় আগমনের দ্বারপ্রান্তে। চেয়ে দেখ আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। প্রকৃতির অঘোম নিময়ে তোমার আয়ু শেষের দিকে। আমি নামবো খুব শীঘ্রই শান্তির ফোঁটা হয়ে। বিদায়ের প্রাক্কালে, শেষবারের মতো চেয়ে দেখ গ্রীস্ম, "আকাশের বুক কেমন ভাবে কালো ঘন মেঘে ভারী হতে শুরু করেছে ।" কিছু সময় পরে আকাশ তাঁর ভারাক্রান্ত বুক উন্মোচন করে মুষলধারে নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে। আমার আসার তীব্র আওয়াজে থেমে যাবে তোমার উদ্দাম নৃত্য, ভয়ে জর্জরিত হয়ে উঠবে তোমার পুরো শরীর। আমার বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে অবিরাম ধারায় ঝড়ে পড়ার প্রতিটি কোনায় তোমার সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠবে। আর তোমার এই মৃত্যু যন্ত্রনায় রিক্ত হয়ে উঠবে প্রকৃতির রুক্ষ, শুস্ক জরাজীর্ন অন্তর।
আমি জানি, আমি ক্ষুদ্র, নগন্য ও তুচ্ছ। আমার জলের ক্ষুদ্র ফোঁটা গুলো একা একা নামলে তোমার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা পবিত্র ধরিত্রী ভূমি স্পর্শ করার বহু পূর্বেই শেষ করে ফেলবে। তবে আমি একতায় বিশ্বাস করি। আমি জানি, এক সঙ্গে ঝড় পড়লে তোমার পতন নিশ্চিত করে আবারও প্রকৃতির মাঝে ফুটিয়ে তুলবো নতুন প্রান । মৃতপ্রায় প্রকৃতিকে আবারও সজীব করে তুলবো পুরোদমে। ফাটল ধরা ভূমিকে আবারও শস্য দিয়ে করে তুলবো সবুজ শস্য-শ্যামলা। কোনো রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নদীর বুক ভরিয়ে তুলবো। দেখলে মনে হবে কোন লাস্যময়ী যুবতীর যৌবন ছাপিয়ে পড়ছে দেহের সর্বাঙ্গজুড়ে। আবারও প্রেম জাগাবো প্রকৃতির মাঝে। প্রকৃতির এই প্রেমের উদ্যানে জোড়ায় জোড়ায় হৃদয়ঙ্গমে মত্ত হয়ে উঠবে পাখি থেকে শুরু করে সর্বপ্রকারের জীব। যে চাতক পাখির ডাকে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতো প্রকৃতি, সেই চাতক পাখির ডাকে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে প্রকৃতির গহীন অন্তর। ভালোবাসায় মুখরিত হয়ে উঠবে আকাশ-বাতাস ও নদীর ওই প্রান্তর।
তবে আমি বর্ষা, আমি অকৃতজ্ঞ নয়। গ্রীস্ম! আমি তোমায় ধন্যবাদ জানায়। কারন তোমার ওই বিধ্বংসী রুপের মধ্য দিয়েই আমার আগমনের পথ প্রসস্থ হয়। তোমার আগমন হয় বলেই আমার প্রতীক্ষার প্রহর গুনে ওরা। তবে আমারও সময় ফুরাবে প্রকৃতির ছন্দবদ্ধ নিয়মে। আমার যেখানে শেষ হবে, সেখান থেকে হেমন্তের পথ চলা শুরু হবে। গ্রীস্ম তুমি যেখানে, "তোমার সর্বগ্রাসী রুপ দেখিয়ে আমাকে ব্যঙ্গ করো।" আমি সেখানে অগ্রিম স্বাগতম জানায় হেমন্তকে। কারন আমি বিশ্বাস করি উদারতায়, ভালোবাসায় শান্তিতে। আমি গর্ব করে বলতে পারি, "ঋতুর মধ্যে আমিই সেরা।" আমি নিজেকে মনে করি, "আমি আরবীয় উপন্যাসের নাইটঙ্গেল পাখি।" যে পাখির সুরে মরুভূমির মাঝে মরীচিকায় কবলে দিকভ্রান্থ পথিক মুহুর্তের জন্য সবকিছু ভুলে সাময়িক প্রশান্তি লাভ করে। তেমনীভাবে আমার আগমনে অতীতের সব গ্লানি ভুলে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে প্রকৃতি। আমি আসি বলেই, "ওরা বীজ বোনে, চাষ করে মহা আনন্দে।" আমি আসি বলেই, "জন্ম নেয় নতুন স্বত্ত্বার প্রকৃতির মাঝে ।" আমি সৃষ্টির আদি থেকে এখন পর্যন্ত নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচায়!
No comments